গামরির তীরে || সিদ্ধার্থ পাল
পাহাড়ি ঝর্নার ওপরে কুয়াশার মেঘ জমেছিল। সেই মেঘই ধীরেধীরে, গুড়ি মেরে উঠে এসে উপত্যকার পাইন, দেবদারু, রডোডেনড্রনগুলোর মাথা, ভেজা চাদরে ঢেকে দিয়েছে। অমাবস্যার জঙ্গল তাই আরও আবছা, আরও রহস্যের আবহে আচ্ছন্ন। বেশ কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে শুঁড়ি পথে কোনো অবয়বের নড়াচড়া আন্দাজের বিফল চেষ্টা করলাম। তারপরে, অভ্যাসবসত হাত চলে গেল টেবিলের দিকে, চায়ের ফ্লাস্কের খোঁজে। জমাট অন্ধকার হাতড়ে যেটার নাগাল পেলাম, সেটাকে কোনোভাবে ফ্লাস্ক বলা চলে না। ওটি তিব্বতি ছাংয়ের খালি বোতল। মুহূর্তের জন্যে সব যেন গোলমাল হয়ে গেল। কোথায়, কেন বসে আছি, কিছুই মনে পড়ল না। দু’হাতে মাথা চিপে খানিকক্ষণ ঝুঁকে থাকার পর মগজের কুহেলিকা খানিক পরিস্কার হল।
গত তিন মাস, আমি ভুটানের স্কাতেং সংরক্ষিত বনভূমিতে, গামরি নদীর পাড় ঘেঁসে বানানো এই ইংরেজ আমলের পরিত্যক্ত বাংলোকে আস্তানা বানিয়েছি। এসেছি এ’দেশের সরকারের বিশেষ অনুরোধে, এক নরখাদক পাহাড়ি লেপার্ড শিকারের আশায়। বাঘটি বিগত ছ’মাসে দক্ষিন-পূর্ব ভুটানের জঙ্গল সংলগ্ন লোকালয়গুলোকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। অনেক গবাদি পশু ছাড়াও দশজন দুর্ভাগা গ্রামবাসী এবং একজন শিকারিও তার সন্ত্রাসের বলি হয়েছে, এখন পর্যন্ত। আমি জীর্ণ বন বাংলোটিতে ঘাটি গেঁড়ে, এক মংপা বন্দুকবাজকে সাথী বানিয়ে সেই আততায়ীর পিছু নিয়েছি। প্রচণ্ড ধুরন্ধর প্রাণীটি দিনের পর দিন আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলেছে। মাচার চারিদিকে পাক খেয়েছে অথচ চারকে দাঁতে কাটেনি।
বারান্দার ঠিক নিচের চাতাল থেকে কিছু একটা ভাঙ্গার “মট” করে শব্দ কানে এলো। চেয়ারের পাশে কাত করে রাখা হান্টিং রাইফেলটা হাতে নিয়ে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালাম। মাথা সামান্য টলে উঠলেও নির্ভুল অশনি ইঙ্গিত আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ করে দিয়েছে। নাক বুঁজে আসছে বোটকা বুনো গন্ধে। সে এসেছে। মনে পড়লো, মংপা আমায় ডাকতে এসেছিল বিকেলে। গামরির তীরে বাঘের নতুন পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। সেখানে ফাঁদ পাততে যাবে। কুকরি মুছতে মুছতে আমি বলেছিলাম, “এবারে নতুন চার দিয়ে মড়ি করবো। ফাঁকি দিতে পারবে না।“
সন্তর্পণে বারান্দার নড়বড়ে রেলিংয়ে ভর দিয়ে উঁকি মারতেই, তাকে দেখলাম। ঘাসের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা জোঙ্গা জিপ আর বাংলোর দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ির ঠিক মাঝ বরাবর, সিমেন্টের চাতালের ওপরে, ছিন্নভিন্ন মানব শরীরের পাশে বসে আছে মানুষখেকোটা। নির্মেঘ আকাশে তারার আলো প্রতিফলিত হচ্ছে ওর মখমলি গায়ে। হলুদের ওপরে কালো চাকাগুলো দ্রুত ওঠানামা করছে শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে তাল মিলিয়ে। পরম আয়েসে সে সশব্দে চিবাচ্ছে নিঃসাড় শিকারের ডান কব্জি। অন্য হাতের ঢিলে হয়ে আসা রোলেক্স ঘড়িটা মংপাকে গতকাল সকালেই উপহার দিয়েছিলাম। আজ তাই খুলে রাখতে ইচ্ছে হয়নি।
হয়তো আমার উত্তেজনার সংকেত ধরা পড়েছিল ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে। স্কাতেংয়ের আতঙ্ক, মুখ তুলে এ’দিকেই তাকাল। সেই দৃষ্টিতে আছে প্রচ্ছন্ন এক অমোঘ আকর্ষণ যা স্থবির করে দেয় চিন্তাশক্তি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম হিংস্রতার নিষ্পাপ অভিব্যক্তিকে। ট্রিগারে আঙ্গুল ছুঁইয়ে ওর চোখের সাথে চোখ মেলালাম। ধরা পড়ে গেছে সে আমার কাছে। মানুষের মড়ির লোভ সামলাতে পারবে না আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু ও যেন আমায় দেখেও দেখছে না। আমার উপস্থিতিতে উপেক্ষা করে চেয়ে রয়েছে আরও পিছনে কোথাও। ভাবলাম, আসন্ন মৃত্যুর সামনে জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পেয়েছে মনে হয়।
ছাংয়ের চড়া ঘ্রাণ লেপার্ডের জান্তব উপস্থিতিকে ছাপিয়ে গেলো এবারে। আমার ঘাড়ের খুব কাছ থেকেই আসছে সেটা। কি অদ্ভুত না? বোতল তো সেই বিকেলেই শেষ হয়ে গেছে। মংপাই বেশি টেনেছিল। চাতালে নিয়ে গিয়ে ওর নাড়িভুঁড়ি কাটতেই রক্তের সাথে ছাং ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে। সেই একই গন্ধ আবার ফিরে এসেছে আমার পিছনে। তাহলে কি…?
নিশানা সোজা রেখেই দুরুদুরু বুকে নজর ঘোরালাম। রক্তস্নাত শরীরে মংপার ধোঁয়াটে দেহ আমায় বলল, “শিকারিবাবু, ধাপ্পা!”
শি ল্প জ গ ৎ
লেখা পাঠানোর ই-মেল – shilpajagatbangla@gmail.com
আমাদের ফেসবুক পেজ
আরও পড়ুন –
Discussion about this post